ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মামলার প্রস্তুতি: লন্ডনের বিক্ষোভের আড়ালে যে আইনি লড়াই।





🖊️ রিপোর্ট: লন্ডন থেকে সুষমা চাকমা -
 তারিখ: ১৪ জুন ২০২৫
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা নতুন মাত্রা যোগ করেছে—বিশেষ করে, যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত মানবাধিকার আইনজীবী দল তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (ICC) মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সরাসরি যুদ্ধাপরাধ নয়, বরং তাঁকে “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ” (Crimes Against Humanity) ধারায় অভিযুক্ত করার পরিকল্পনার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশ নড়েচড়ে বসার মতো ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আইনি উদ্যোগের উৎস কোথায়?
লন্ডনের Doughty Street Chambers—বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার চেম্বার। এখানকার ব্যারিস্টার Steven Powles KC এবং তাঁর আইনি দল গত কয়েক মাস ধরেই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সহিংসতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন, সাংবাদিকদের হয়রানি, গ্রেপ্তার এবং আদালতের বাইরে মব–নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করছেন। উল্লেখ্য এই প্রতিষ্ঠানটি সাথে পৃথিবীর নামকরা আইনজীবীরা জড়িত রয়েছেন এবং মানবাধিকার কর্মীরাও সম্পৃক্ত রয়েছেন বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও এই ল ফার্মটির  সাথে সংযুক্ত রয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানটির দাবি, ড. ইউনূস ২০২৪ সালের ৮ আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকারে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এসব ঘটনার “পরিচালন ও অনুমোদনের” ভূমিকা পালন করেছেন। এসব ঘটনাকে তারা মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় ফেলছেন, যার ভিত্তিতে তাঁরা ICC-এর Article 15 communication জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
কী রয়েছে Article 15-তে?
Article 15 হলো এমন একটি আইনি প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটরের কাছে সরাসরি অভিযোগ দাখিল করতে পারে, যাতে তিনি একটি প্রাথমিক তদন্ত শুরু করতে পারেন। এর মাধ্যমে মামলাটি আদালতে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত না হলেও, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ যা ভবিষ্যতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক মামলার ভিত্তি হতে পারে।
ডরচেস্টার হোটেল ঘিরে নাটকীয়তা
ড. ইউনূস যখন লন্ডনের Dorchester Hotel-এ অবস্থান করছিলেন, তখন হোটেলের বাইরে শতাধিক মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেন। “মব রুলের নেতা”, “মানবাধিকারের খুনি”—এমন সব প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে তাঁরা দাবি তোলেন, আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর বিচার হওয়া উচিত।
আন্দোলনকারীদের দাবি, ইউনূস সরকার দেশে “নির্বাচনবিহীন, শক্তিবলে ক্ষমতা ধরে রাখা সরকার পরিচালনা করছেন”, যার অংশ হিসেবে “রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চালানো হচ্ছে”।

প্রতিরোধ নাকি প্রতিশোধ? রাজনৈতিক বিতর্ক
এই পদক্ষেপটিকে কেউ কেউ “আইনের পথে আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা” হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ কেউ এটিকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবেও ব্যাখ্যা করছেন।
যাঁরা ড. ইউনূসের সমর্থক, তাঁদের বক্তব্য—এই উদ্যোগ তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র। কারণ ইউনূস আন্তর্জাতিক মহলে অত্যন্ত সম্মানিত এবং তিনি পূর্বে সরকারবিরোধী অবস্থানে থাকায় অনেকের রোষের শিকার হয়েছেন।
অন্যদিকে, বিরোধীপক্ষ বলছে—নোবেল পাওয়ার পাশাপাশি কেউ দায়মুক্ত নয়, বিশেষত যদি তাঁরা কোনো প্রশাসনিক দায়িত্বে থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।

তথ্য-প্রমাণের জোর কতটা?
আইসিসি–তে কোনো কেস গৃহীত হলে তা “প্রমাণভিত্তিক” হতে হয়। Doughty Street-এর আইনজীবীরা ইতিমধ্যে ভিডিও ফুটেজ,নির্যাতনের শিকারদের সাক্ষাৎকার,সংবাদ প্রতিবেদন এবং পুলিশের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা সংগ্রহ করেছেন বলে জানা গেছে।
তবে এটি এখনো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। আন্তর্জাতিক আদালতে প্রমাণের মান অনেক উঁচু স্তরের—তাই এটিকে “মামলা হওয়ার প্রথম ধাপ” হিসেবে ধরা হলেও, বিচার শুরু না হওয়া পর্যন্ত এটি আইনি পর্যায়ে সীমিত।

যদি মামলা গৃহীত হয়, কী হতে পারে? আইসিসি ড. ইউনূসকে সমন জারি করতে পারে;বিদেশ ভ্রমণে বাধা সৃষ্টি হতে পারে; বাংলাদেশের সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে; এবং তাঁর সম্মানজনক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা দায়েরের এই উদ্যোগ এখনো একটি প্রাথমিক ধাপে রয়েছে, কিন্তু এর প্রভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বাংলাদেশের প্রশাসনের ওপর পড়তে শুরু করেছে।

এই ঘটনার গভীরে যে প্রশ্নটি এখনো জ্বলছে তা হলো:
নোবেল বিজয়ীর সম্মান তাঁকে দায়মুক্তি দেয়, নাকি সেই সম্মানই তাঁকে আরও বেশি দায়বদ্ধ করে তোলে?



Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url